টিনিটাস: এক নিরব অথচ বিরক্তিকর শব্দ

পরিচিতি

টিনিটাস (Tinnitus) শব্দটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত না হলেও, এই সমস্যার সম্মুখীন বহু মানুষ প্রতিদিন হন। এটি একটি সাধারণ অথচ জটিল শারীরিক সমস্যা, যেখানে ব্যক্তি তার চারপাশে কোনও বাহ্যিক উৎস ছাড়াই কানে বিভিন্ন ধরনের শব্দ শুনতে পান, যেমন – সিসি শব্দ, হুইসেল, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, বাজ বা ঘণ্টাধ্বনি ইত্যাদি। এই শব্দগুলি একটানা হতে পারে, আবার থেমে থেমেও আসতে পারে। কখনো কখনো এটি এতটাই বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে যে, এটি ঘুম, মনোযোগ এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত ঘটায়।

বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন, এবং বাংলাদেশেও দিন দিন এর প্রকোপ বাড়ছে। তবে সঠিক জ্ঞান ও চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

টিনিটাসের ধরন

টিনিটাস মূলত দুটি প্রকারের হতে পারে:

১. সাবজেকটিভ টিনিটাস (Subjective Tinnitus)

এই ধরনের টিনিটাসে কেবল আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেই শব্দটি শুনতে পান। এটি সবচেয়ে সাধারণ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রবণ স্নায়ুর সমস্যার কারণে ঘটে।

২. অবজেকটিভ টিনিটাস (Objective Tinnitus)

এই ধরনের টিনিটাস তুলনামূলকভাবে বিরল। এর ক্ষেত্রে ডাক্তার বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে শব্দটি শুনতে পারেন। এটি সাধারণত রক্তনালী, পেশি স্পাজম অথবা কানের অভ্যন্তরের কিছু যান্ত্রিক কারণে হয়ে থাকে।

টিনিটাসের কারণ

টিনিটাসের পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে কিছু সাধারণ কারণ হলো:

  • কর্ণপ্রবেশে ক্ষতি: দীর্ঘদিন উচ্চ শব্দে গান শোনা বা কাজের পরিবেশে অতিরিক্ত শব্দে থাকার ফলে কানের অভ্যন্তরের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • বার্ধক্যজনিত শ্রবণ শক্তির অবনতি: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়ার কারণে অনেক সময় টিনিটাস হয়।
  • কান বন্ধ হয়ে যাওয়া (ear wax build-up): অতিরিক্ত ইয়ারওয়াক কানের মধ্যে জমে গেলে তা কানে চাপ সৃষ্টি করে এবং টিনিটাস হতে পারে।
  • ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ, এন্টিডিপ্রেসেন্ট এবং অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ টিনিটাস সৃষ্টি করতে পারে।
  • মাথা বা ঘাড়ে আঘাত: ট্রমা বা দুর্ঘটনায় মাথা বা ঘাড়ে গুরুতর আঘাত পেলে শ্রবণ স্নায়ুতে চাপ পড়ে এবং টিনিটাস দেখা দিতে পারে।
  • মেনিয়ারের রোগ (Meniere’s Disease): অভ্যন্তরীণ কানের এই সমস্যাটির সঙ্গে টিনিটাস ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
  • চাপ ও উদ্বেগ: অতিরিক্ত মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা এবং অবসাদ থেকেও টিনিটাস শুরু হতে পারে।

লক্ষণ

টিনিটাসের মূল লক্ষণ হলো:

  • কানে সিসি ধ্বনি শোনা
  • ঘড়ঘড় শব্দ
  • হুইসেল বা বাঁশির মতো শব্দ
  • ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মতো আওয়াজ
  • একটানা অথবা থেমে থেমে শব্দ শোনা

অনেক সময় এই শব্দগুলো কেবল রাতের সময় বা নিরিবিলি পরিবেশে বেশি প্রকটভাবে অনুভূত হয়।

টিনিটাসের প্রভাব

টিনিটাস শুধু কানের সমস্যা নয়, এটি ব্যক্তির মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। যারা দীর্ঘদিন এই সমস্যায় ভুগছেন, তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো দেখা যেতে পারে:

  • ঘুমে সমস্যা
  • মনোযোগে ব্যাঘাত
  • মানসিক অবসাদ
  • উদ্বেগ
  • রাগ ও বিরক্তি
  • কর্মদক্ষতার হ্রাস

টিনিটাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষা

টিনিটাস নির্ণয়ের জন্য শ্রবণ বিশেষজ্ঞরা কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা করে থাকেন:

  • অডিওমেট্রি টেস্ট: শ্রবণ শক্তির স্তর পরিমাপ করা হয়।
  • টাইম্পানোমেট্রি: কানের পর্দা ও মধ্যকর্ণের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়।
  • MRI বা CT স্ক্যান: অভ্যন্তরীণ কোনো শারীরিক সমস্যা আছে কি না তা শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়।

চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা

টিনিটাসের জন্য একক কোনো চিকিৎসা নেই, তবে কারণ অনুসারে চিকিৎসা করলে অনেক সময় উপশম পাওয়া যায়। নিচে কয়েকটি সাধারণ ব্যবস্থাপনার কথা বলা হলো:

১. শ্রবণযন্ত্র (Hearing Aid):

যাদের শ্রবণ শক্তি হ্রাস পেয়েছে, তাদের জন্য হিয়ারিং এইড ব্যবহার করে টিনিটাসের শব্দ ঢেকে ফেলা যায়।

২. সাউন্ড থেরাপি:

ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা সঙ্গীত, সাদা শব্দ (white noise) বা প্রাকৃতিক শব্দ চালিয়ে কৃত্রিমভাবে কানের আওয়াজ কমিয়ে আনা হয়।

৩. কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT):

এই থেরাপি মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও টিনিটাসজনিত বিরক্তি কমাতে সাহায্য করে।

৪. ওষুধ:

যদিও টিনিটাস নিরাময়ের জন্য সরাসরি ওষুধ নেই, তবে দুশ্চিন্তা বা ঘুমের সমস্যা থাকলে সেগুলোর জন্য ওষুধ দেওয়া হয়।

৫. ধ্যান ও রিলাক্সেশন:

ধ্যান, যোগব্যায়াম এবং গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস অনুশীলন করে মানসিক শান্তি এনে টিনিটাসের প্রভাব কমানো যায়।

প্রতিরোধ

টিনিটাস প্রতিরোধের কিছু উপায় রয়েছে:

  • উচ্চ শব্দ থেকে কান রক্ষা করা
  • কানে ইয়ারফোন দিয়ে জোরে গান না শোনা
  • ইয়ারওয়াক নিয়মিত পরিষ্কার রাখা
  • স্ট্রেস বা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
  • স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন

বাংলাদেশে টিনিটাস চিকিৎসা

বাংলাদেশে বর্তমানে অনেক আধুনিক হিয়ারিং সেন্টার, ক্লিনিক ও ইএনটি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন যারা টিনিটাস সমস্যার সমাধানে কাজ করছেন। “ডিজিটাল হিয়ারিং সলিউশন”, “হিয়ারিং এইড সেন্টার” ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রবণ পরীক্ষার পাশাপাশি শ্রবণযন্ত্র, কাউন্সেলিং এবং থেরাপি সেবা দিচ্ছে।

উপসংহার

টিনিটাস একটি জটিল কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য সমস্যা। একে উপেক্ষা করলে দীর্ঘমেয়াদে মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। তাই সময়মতো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া, উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। আপনি যদি মনে করেন, আপনার কানে কোনো অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাচ্ছেন, তবে দেরি না করে একজন অভিজ্ঞ ইএনটি বিশেষজ্ঞ বা অডিওলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

প্রয়োজনে পরামর্শ নিতে পারেন:
Hearing Store
📞 যোগাযোগ: +8801859 244144
🌐 ওয়েবসাইট: Hearing Store